Advertisement

শুক্রবার, ৩০ সেপ্টেম্বর, ২০১৬

 

" পৃথিবীর সব কাহিনী নিয়ে গল্প হয় না। আবার সব গল্পও যে কোন কাহিনীর উপর ভিত্তি করে হবে তারও নিশ্চয়তা নেই। তাই আমার গল্পগুলোর কোন নাম নেই। বেনামী গল্প...
চিরকুটটা কে বা কারা আমাকে দিয়েছিল আমি মনে করতে পারছি না। সকালে ঘুম থেকে উঠে প্রায় আধা ঘন্টা বসেছিলাম চিরকুটটা নিয়ে। কে হতে পারে?? কি হতে পারে?

নাহ..চিন্তা করতে পারছি না। হয়ত চিন্তার শেষ লিমিট ক্রস করেছি। আচ্ছা আমার পরিচয় দেই। আমি অতনু বর্মন। থাকি বাংলাদেশ ইন্ডিয়া বর্ডারের কাছে কোন একটা বাংলো বাড়িতে। এই মূহুর্তে মনে করতে পারছি না। পরে কোন একসময় মনে হলে বলে দিবো।

আমি এখানে আছি ২৮ বছর ধরে। সাথে আমার স্ত্রী আর দুইটা মেয়ে। ছোট টা তুলিকা আর বড়টা হিমিকা। রিটায়ার্ড আর্মি অফিসার। চাকরিটা ছেড়েছি বেশিদিন হয় নি। বছর দুয়েক হবে কিনা কে জানে ! দিনক্ষণ এর হিসাবটা আমি মিলাতে পারি না। মাথাটা যন্ত্রনা দেয়। একটু দাঁড়ান। আমি আমার স্ত্রীকে নাস্তাটা দিতে বলি।

-এই,নাস্তা দিবে না?? সকাল তো হয়ে গেল।আমি মর্নিং ওয়াকে যাচ্ছি।
-কই নাস্তা?? তুমি কেমন জানি হয়ে যাচ্ছ দিনদিন। আজকাল আমার কথা শোন না। একদম না। আমার কিন্তু খুব রাগ লাগে।
আপনি কিছু মনে করবেন না। কেমন?? আসলে ওর নিজেরও তো বয়স হয়েছে। ভুলে যায় অনেক কিছু। আপনি বসুন আমি নাস্তা টা নিয়ে আসি।

রান্না ঘরে যেয়ে দেখি আমার গিন্নী মানে প্রীতিলতা দেবী বসে আছেন। আমি তাকে জিজ্ঞাস করলাম নাস্তা দিতে এত দেরি হচ্ছে কেন। কোন উত্তর পেলাম না। আমার মনে হয় ওকে একজন ভাল ডাক্তার দেখানো উচিত।
আমি আবার শোবার ঘরে ফিরে আসলাম নাস্তা হাতে।

-আপনাকে অনেকক্ষণ বসিয়ে রাখলাম। আমি অত্যন্ত দু:খিত। আপনি কিছু মনে করেন নি তো??

নাস্তা শেষে আমরা হাঁটতে হাঁটতে বটগাছটার নিচে গেলাম। এই বটগাছটার নিচটুকু আমার অনেক পছন্দের একটা জায়গা। জানেন?? আমি যখন ছোট ছিলাম মানে ক্লাস সিক্স কি সেভেন এ পড়ি তখন বাবা বদলি হয়ে যায়। আমরা হবিগঞ্জ ছেড়ে চলে আসি একেবারে খুলনাতে। আমার হাতে লাগানো একটা গাছ ছিলো। জানেন?? এখন কেউ না কেটে থাকলে হয়ত এমন ই বড় হয়ে গেছে তাই এই গাছটার কাছে আসলে আমার অনেক আপন আপন লাগে।


এককালে স্কুল কলেজে ভাল লেখালেখি করতাম। ও আচ্ছা, আপনাকে তো আমার লেখা গল্পসমগ্রের বইটা দিতে মনে নেই। যাবার সময় একটা সৌজন্য কপি নিয়ে যাবেন। কেমন?? আসলে এত মানুষ বই চায় যে না করা যায় না। আরে বাবা এতই যখন পড়ার ইচ্ছা তখন নিজে একটা কিনে নিলেই পাড়ে? কতই আর লাগে। ঠিক বলছি না বলুন??
আচ্ছা যেটার জন্য আপনাকে ডাকা। আপনার পরিচিত কোন মানসিক রোগের ডাক্তার আছেন?? দেখলেনই তো আপনার বৌদি কি করল সকালে??কি একটা বাজে অবস্থা ! আপনিই বলুন। একটু তাড়াতাড়ি খোঁজ করবেন। কেমন?? আমি আর কারো উপরেই ভরসা পায় নি।


ভাবছেন আমার মেয়েরা কোথায়?? বড় মেয়েটার বিয়ে হয়ে গেছে। ডাক্তার ছেলে। অনেক নাম ডাক। একটা ফুটফুটে নাতনীও আছে আমার। ভড়কে গেলেন তো?? অ্যাই অ্যাম অলওয়েজ ইয়াং ইন মাই মাইন্ড।

আর ছোটটার কথা বলবেন না। নামের সার্থকতা রেখেছে। ছোট বেলা থেকেই রঙ তুলি ছিল ওদের মায়ের খুব প্রিয় জিনিস। যখনই অবসর পেত রঙ তুলি নিয়ে বসে যেত। মায়ের থেকে শিখেছে। বুঝলেন?? ছোট বেলা থেকেই রঙ তুলির নেশা। আমিও না করি নি। আমি নিজে লেখক হতে চেয়েছিলাম।


কি হল বলুন?? বাস্তবতার চাপে পড়ে জীবন কাটিয়ে দিলাম আর্মি ক্যাম্পে ক্যাম্পে। তুলিকা চারুকলায় পড়ছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। মেয়েটা আমার চোখের সামনে দিয়ে বড় হয়ে গেল।


জানেন,একদিন আমি ছিলাম ক্যাম্পে। ওদিকে ওদের মা,ওরা। সে কি ঝড় ! আমার চিন্তায় ঘুম নষ্ট হয়ে যাচ্ছিল। তখন তো আর এখনকার মত ইন্টারনেট,টেলিফোন ছিল না এত। চিঠি লিখতাম। কি আর করবো বলুন?? কখনো আর্মি তাবুর নিচে হারিকেনের আলোয়, কখনো ডর্মে শুয়ে হাতের কাছে থাকা টর্চের আলোয়। আমরা লিখে যেতাম। অপেক্ষা করতাম চিঠির জন্য। সে এক অন্য জগত। আপনি এখনকার জামানার মানুষ। হয়ত এতটা অনুভবও করতে পারবেন না। কি দিন ছিল ! মিশনে যেয়ে যুদ্ধের মাঝে এক একটা রাত আমরা কিভাবে কাটিয়েছি শুধু আমরাই জানি। দেশে আমার চিন্তায় ও ঘুমুতে পারছে না আর মিশনে আমি ওর চিন্তায়।


জানেন আপনাদের বৌদির হাতের রান্না খুব মজার। যদিও এখন বয়স হয়ে যাওয়ায় ভুলে যায় নুনের পরিমাণ ঠিক আছে কিনা,কিংবা ভুল মশলা দিয়ে ফেললো কিনা। এ নিয়ে আমার কোন আপত্তি নেই। কেনই বা থাকবে বলুন?? যে মানুষটা এত বছর আমাকে রান্না বান্না করে খাইয়েছে, আমরা প্রতিটা কাজে যত্ন নিয়েছে,আমাকে আসলে আমি'র সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে তাকে কি এই শেষ বয়সে এসে কিছু বলা যায় বলুন??

আমার না খুব খারাপ লাগে। ভাবি মানুষ কেন বুড়ো হয়?? আমিও বুড়ো হয়ে যাচ্ছি। সেও বুড়ো হয়ে যাচ্ছে। এক সময় হার মানিয়ে দিয়েছিলাম বয়সকে আর এখন আমরাই হার মেনে গেছি বয়সের কাছে । জীবনটাই এমন।

আচ্ছা,আমি আপনাকে খুব বিরক্ত করছি। তাই না?? আড্ডা দিতে দিতে কখন যে সন্ধ্যা হয়ে গেল টেরই পেলাম না। আপনি মনে হয় এবার উঠবেন?? লেখক ছিলাম একসময়। মানুষের মনের কথা একটু হলেও বুঝি। হা হা হা... কিছু মনে করবেন না।
আমারও ঘুম পেয়েছে। মাথাটা খুব যন্ত্রণা দিচ্ছে। একটু ঘুমানো উচিত। আমার গল্পের বইটা নিবেন না?? দাঁড়ান আপনাকে একটু চিরকুট লিখে দেই। আপনার মনে থাকবে সবসময় আমাকে। একটু দাঁড়ান। আমি যাবো আর আসবো।

চিরকুটটা এখনই পড়ে দেখুন। আচ্ছা,দাঁড়ান আমিই পড়ে শুনাই। আপনার পড়ার আগ্রহটা আরো বেড়ে যাবে। বই এর নাম "যে গল্পের কোন নাম নেই" ।

আর চিরকুটে লেখা "পৃথিবীর সব কাহিনী নিয়ে গল্প হয় না। আবার সব গল্পও যে কাহিনীর উপর ভিত্তি করে হবে তারও কোন নিশ্চয়তা নেই। তাই আমার গল্পগুলোরও কোন নাম নেই। বেনামী গল্প.... "

আচ্ছা, আপনি যান এখন। আমামার খুব মাথা ধরেছে। আমি ঘুমাবো এখন... কি হল?? যান তো।

সিস্টার এসে ঘুমের ওষুধ দিয়ে দিলো।

-স্যার,পেশেন্টের অবস্থা তো ভাল মনে হচ্ছে না।
-প্রতিদিন এক কাহিনী বলছে সবাইকে। তারপর একটা চিরকুট লিখে মাথার চুল ধরে টানাটানি করছে। প্রতিদিনই এই কাজটা করছে। এক পর্যায়ে আমরা সিডাটিভ দিয়ে ঘুম পাড়ানোর ব্যবস্থা করি।
-স্যার আমাকে পেশেন্ট এর ফাইলটা একটু দেয়া যাবে??
-হুম। শিউর। আপনি সিস্টারের কাছে যেয়ে ৩২ নম্বর কেবিনের ফাইলটা নিয়ে দেখতে পারেন।
-থ্যাংকিউ স্যার।


আমি যেয়ে ফাইলটা নিলাম। ফাইলের উপরে বড় বড় করে লেখা "আয়শা মেমোরিয়াল মানসিক হাসপাতাল"। কেন জানি লেখাটায় চোখ আটকে গেল। আমি পড়তে শুরু করলাম।


কেস নং- ২২১/বি/৩২
নাম-অতনু বর্মন
পেশা- ২য় ল্যাফটেনেন্ট,বাংলাদেশ আর্মি।
পরিবার-
স্ত্রী :মৃত প্রীতিলতা দেবী
কন্যা ১: মৃত হিমিকা দেবী (১৩ বছর)
কন্যা ২ :মৃত তুলিকা দেবী ( ৮ বছর)
কেস বর্ণনা-

"আনুমানিক চার বছর আগে অতনু বর্মন নামের এক আর্মি অফিসার তার পরিবার সহ মারাত্নক এক্সিডেন্টের মুখোমুখি হন। অন স্পটে উনার স্ত্রী প্রীতিলতা দেবী, বড় কন্যা হিমিকা দেবী,ছোট কন্যা তুলিকা দেবী নিহত হন। আহত অতনু বর্মনকে ঢাকা মেডিকেলে নেয়া হয়। মাথায় মারাত্মক আঘাত প্রাপ্ত হন। সেরেব্রাল ড্যামেজ,থ্যালামাস ড্যামেজ হয় আংশিক। সেই থেকে তিনি উল্টা পাল্টা কথা বলেন। কাল্পনিক কাহিনী বলেন।গত বছর থেকে এই সমস্যা অনেক বেড়ে গেছে। প্রথমে অদ্ভুত কাল্পনিক কথোপকথন,তারপর চিরকুট লিখে যাওয়া। বর্তমানে তিনি এই সমস্যার মধ্য দিয়েই যাচ্ছেন "
আমি থমকে গেলাম পুরোটা পড়ে । কিছু বলার ভাষা খুঁজে পাচ্ছিলাম না। পকেটে অতনু বর্মনের হাতে লেখা চিরকুটটা ছিলো। টেবিলের উপর থেকে নিয়ে এসেছিলাম।


কোন কোন গল্পের সত্যিই কোন নাম হয় না। কিছু গল্প আসলেই বেনামী .......


(সমাপ্ত)

২টি মন্তব্য: